ব্রেকিং নিউজ
হজযাত্রীদের ভিসা অনুমোদনের সময় বাড়াতে সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পাবনার শ্রীধরকুড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে টিফিন বক্স বিতরণ সিটি ইউনিভার্সিটির ৪র্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত , সনদ পেলেন ৯৫৯২ শিক্ষার্থী ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করায় জবি শিক্ষার্থীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড পুনর্গঠিত সেন্সর বোর্ডে নতুন কমিটিতে জায়গা পেলেন একঝাঁক তারকা ভালুকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মা ও শিশুর পরিচয় মিলেছে
×

মো. সাইদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১/২/২০২২ ৮:৪২:১২ PM

নিশুথি রাতের গল্প

ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রায়  শ’দেড়েক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে আমি ও আরো দুই গ্রামের দু’জন ছেলে আমরা বৃত্তিধারী ছিলাম। সংগত কারণে আমাদের প্রতি স্যারদের আলাদা দৃষ্টি ছিল।

তখন আমি নবম কিংবা দশম শ্রেণির ছাত্র। ছাত্রজীবনে এতগুলো ক্লাশ পার হয়ে এলাম তবে কখনো প্রথম হতে পারিনি। পঞ্চম শ্রেণিতে গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করি।

পাশের গ্রামের চৌ-বাড়ী ইসলামিয়া হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। অনেক নাম করা স্কুল। বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। চৌবাড়ী গ্রামের চৌধুরীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্কুল। আশে পাশের দশ-বারটি গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়তে আসে। তাই প্রতিটি ক্লাসেই অনেক ছাত্র-ছাত্রী।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রায়  শ’দেড়েক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে আমি ও আরো দুই গ্রামের দু’জন ছেলে আমরা বৃত্তিধারী ছিলাম। সংগত কারণে আমাদের প্রতি স্যারদের আলাদা দৃষ্টি ছিল।

পড়াশুনা যে পারতাম না তা নয়। কিন্তু একদিন বাংলা স্যারের ক্লাশে কোন একটি সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুল করি। এতে বাংলা স্যার সবার সামনে আমাকে আমার হাতের খাতাটি কেড়ে নিয়ে খাতা দিয়েই পিটতে থাকেন। শুধু তাই নয়।

পিটানোর সাথে নানা কথা বলে বকতেও থাকেন। এমনকি আমার পারিবারিক প্রসংগ তুলেও কথা বলতে ছাড়েননি। তিনি বলেন “সরকারের খেয়ে কাম নেই, যেই সেই পরিবারের ছেলে-মেয়েকে বৃত্তিদেয়”। আজও জানিনা কেন তিনি আমাকে এভাবে অপমান করলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, ঐ বাংলা স্যার আমাদের গ্রামেরই শিক্ষক ছিলেন এবং আমাদের পরিবারকে ভাল করেই চিনতেন। এরপর আরও দু’ক্লাশ পার হলেম। আমি কোন ক্লাশেই প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারিনি।

সব সময় আমার রোল নম্বর চার কিংবা পাঁচ হয়। অষ্টম শ্রেণিতে ফের বৃত্তি পাই। তখন আমার মনের মধ্যে একটা ইগো কাজ করতে লাগল। ভাবলাম যে করেই হোক আমাকে ক্লাশে প্রথম বা দ্বিতীয় হতেই হবে।

তখন থেকে আমি বাড়িতে সাংসারিক কাজকর্ম থেকে এক প্রকার ছুটিই নিলাম। আমার পরিবার থেকেও আমাকে কোন কাজে চাপ দেয়া হত না।

কৃষকের সন্তান হিসেবে আমাকে কৃষি কাজে প্রায় সহযোগিতা করতে হত। এছাড়া মাছ ধরা ছিল আমার ছোট বেলার অভ্যাস। সেই মাছ ধরার কাজটিও কমিয়ে দিলাম। বাড়িতে পড়াশুনা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলাম।

নবম শ্রেণিতে উঠে স্যারদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়া শুরু করলাম। এত Morning shows the day’’ এর মত হল। ক্লাশে আমার পরিচিতি বেড়ে গেল। ক্লাশের ভাল ছাত্রদের দলে ঠাই পেলাম ভালোভাবে।

নবম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষাতেই এক chance এ first হলাম। তারপর আর কোন ক্লাশেই কোন পরীক্ষাতেই প্রথম বই দ্বিতীয় হলাম না। গানে আছে না “ মা হওয়া কী মুখের কথা’’।

ক্লাশে প্রথম হওয়ার জন্যও আমাকে অনেক সাধনা করতে হয়েছিল। আমার বেশ মনে পড়ে আমার এক অশিক্ষিত চাচী লেখাপড়ার বিষয়ে একটি সুন্দর মন্তব্য করেছিলেন। আমার লেখাপড়ার পিছনে সে কথাটিও আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিল।

কথাটি ছিল - “হাউসে বিদ্যা কৃপণে ধন”। বাস্তবিকই কৃপণতা ছাড়া বুঝি ধন সম্পদের মালিক হওয়া কঠিন। আর লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার জন্য হাউস বা সদিচ্ছা থাকাটা একান্ত প্রয়োজন।

যাই হোক পুরাদমে পড়াশুনা করার জন্য আমকে প্রতিদিন অনেক রাত জাগতে হয়েছে। জানি না কত রাত পর্যন্ত আমি  জেগেছি কারণ তখন কোন ঘড়ি আমার ছিল না।

তবে কয়েকটি প্রাকৃতিক বস্তু আমাকে স্মরণ করে দিত এখন রাত কত হয়েছে। তন্মধ্যে আমাদের বাড়ির পাশেই (উত্তর পাশে) ছিল জঙ্গলকীর্ণ ঘন বন। স্থানীয় ভাবে এটাকে আড়াবন বলা হত।

সেই আড়াবনের এক পাশে ছিল পরিত্যাক্ত একটি ডোবা। ডোবার চারপাশে যেমন ছিল ঘন বন-জঙ্গল, তেমন ডোবাটিও ছিল কচুরিপানায় ঠাসা। সেই কচুরিপানাতে সারা বছরই ডাহুক পাখি বাস করত অনেক। দিনে রাতে ডাকাডাকির অন্ত নাই। দিনের বেলায় ডাহুকের ডাক তেমন কানে আসত না। কিন্তু রাতে যখন চারদিক শুন শান নীরবতা বিরাজ করত।

দিনের কোলাহলময় পৃথিবী রাতের স্তব্ধতায় সম্পূর্ণ রূপে  নিমজ্জিত হত। একটি শুকনো পাতা ঝরার শব্দও কানে বাজত, ঠিক তখনই আড়াবনের ডাহুকের দল একযোগে ডেকে উঠে প্রহর গুণে যেত। ঠিক কতক্ষণ পর পর  ডাহুকের ডাক শোনা যেত তাও ঠিক বলা যাবে না, তবে রাতের মধ্যে বেশ কয়েকবার তাদের ডাক কানে ভেসে আসত। ডাহুকের ডাক শুনে এভাবেই রাতের গভীরতা আন্দাজ করে ঘুমাতে যেতাম।

আর একটি পাখির ডাক শোনা যেত নাপিতপাড়ার জঙ্গলের বড় একটি পাইকর গাছ থেকে। সেই পাইকর গাছের মগডালে কুড়া বাস করত। এটি অনেক বড় একটি পাখি। সারা বছরই ঐ গাছে কুড়া বাস করত।

সে পাখিটিও অনেক রাত অবধি মাঝে-সাঝে ডেকে উঠে জানান দিয়ে যেত এখন রাত কত। সব মিলে প্রাকৃতিক নিয়মেই আমার রাত জাগার হিসেব মেলানো হত। রাত ভারী হলে আমার টেবিলে স্থাপিত হ্যারিকেনের চিমনীটিও কালো ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে আসত।

তখন আমার মনে হত পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ আমিই বুঝি জেগে আছি। আমি ছাড়া আর কেহ পৃথিবীতে আছে বলেও মনে হয় না। এভাবে শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা সব ঋতুতেই চলত আমার রাত জাগার পালা।

তবে একটানা দীর্ঘক্ষণ চেয়ার-টেবিলে বসে থাকাটা যেমন ছিল কষ্টের তেমনি বিরক্তিকর। এছাড়া ঘুম তাড়ানো এবং ক্লান্তি দূর করার জন্যও মাঝে-মাঝে চেয়ার ছেড়ে উঠনে একটু হাটাহাটি করা, একটু বিশ্রাম নেওয়া পড়াশুনার জন্যও বেশ প্রয়োজন ছিল।

এ কারণে প্রায়ই রাতেই দু’একবার করে আমি ঘরের দরজা খুলে হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে ঘরের বাহির হতাম এবং বাহির বাড়িতে গিয়ে পৌঁছতাম।

আমাদের বাড়িটি ছিল গ্রামের সর্ব দক্ষিণে এবং এর পূর্ব দিকটাও ছিল খোলা। তাই সামান্য বাতাসেই আমাদের বাড়ির বহিরাঙ্গন ছিল হাওয়াময়। বাহির উঠানের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালে দক্ষিণ - পূর্বের শীতল হাওয়া অল্পতেই গা জুড়িয়ে (ঠান্ডা করে ) দিত। বিশেষ করে বর্ষা কালেতো এর তুলনাই হয় না।

আমাদের বাড়ির ঠিক পূর্ব দিকে খোলা মাঠ আর মাঠ পেরুলেই একটু দূরে অনেক বড় একটি জলীয় বিল। এটাকে দো-বিল, শাপলার বিল, কৈশোরা বিল ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

কাজেই আমাদের বাড়ি সংলগ্ন ঐ বিল যখন বর্ষাকালে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে সমস্ত মাঠ প্লাবিত হয় তখন দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল একটি জলরাশি (হাওরের মত) মনে হয়। দূরবর্তী গ্রামগুলোকে তখন পানির উপর ভাসমান মনে হয়।

সামান্য বাতাসেই সে খোলা জলরাশির উপর দিয়ে প্রবাহিত ঢেউ গুলো একটার পর একটা সর্পিল গতিতে ভেসে এসে আমাদের আঙিনার ঘাটে থপাস থপাস শব্দ করে আছড়ে পড়ে। চাঁদনী রাত হলে সে দৃশ্য হয় স্বর্গলোকের। সেই দৃশ্য যে দেখেছে শুধু সেই বুঝেছে, অন্যদের বুঝানোও দায়।

আমি এখন এরূপ একদিনের কথা বলব। তখন বর্ষা কিংবা শরৎ কাল। আকাশ মেঘমুক্ত। আকাশে চাঁদ হাসে। বাইরে জোছনার আলোর বিচ্ছুরণ অন্ধকার ঘরের ভিতর ঠিকরে পড়ছে। তখন রাত গভীর হয়েছে। সম্ভবত রাতের দ্বিপ্রহর পার হয়েছে অনেক আগেই।

পৃথিবী নি:শব্দে ঘুমায়। কিছুক্ষণ আগে ডাহুক পাখিদের সমবেত কণ্ঠস্বরের আওয়াজ থেমে গিয়ে রাতের নি:স্তব্ধতাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সে রাতের পড়া শেষ করে আমি বিছানায় ঘুমাতে যাব স্থির করেছি।

কিন্তু বাইরের আলো হাওয়ার লীলা-খেলা একটু উপভোগ না করে কেমনে বিছানায় যাই। বাইরে চাঁদের আলো থাকায় হ্যারিকেনটা সংগে নেয়ার দরকার ছিল না। হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে ঘরের দোর খুলে বাইরে বের হলাম। সোজা চলে গেলাম বাহির বাড়ির সম্মুখ ভাগে সেখানে বন্যার জল এসে স্থলের সাথে মিশে আছে। সম্ভবত শরৎ কাল। তাই আকাশের চাঁদের এত উজ্জ্বলতা। আকাশও সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত।

তাই চাঁদের আলোয় সমস্ত পৃথিবী আজ উদ্ভাসিত। গৃহস্থের টিনের চালে , খড়ের গাদায়, সবুজ গাছপালার পত্র পল্লবে সে আলোর দিপ্তী ছাড়িয়ে এমনি এক অভাবনীয় মোহনীয় রূপের অবতারণার সৃষ্টি হয়েছে যা চোখে না দেখলে ব্যাখ্যা করা যায় না।

কী স্থলে, কী জলে সবত্র একই রূপ। দিগন্ত  Ò Morning shows the day’’  বিস্তৃত জলরাশির উপর দিয়ে ভেসে আসা শীতল হাওয়া শরীর ও মনকে আবেগে আপ্লুত করে ফেলল।

খুব ইচ্ছে হল নৌকা নিয়ে অথৈ জলে নাও ভাসিয়ে দেই। আমাদের বাড়ির ঘাটে দুইটি ভিঙি নৌকা বাঁধা থাকত সব সময়। নানা কাজে এ নৌকা ব্যবহার করা হত। কেউ কেউ রাতে এসে নৌকাতে ঘুমাতো।

কারণ নৌকাতে গুমানো যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ভাল তেমনি নিরালা বাতাসে ঘুমও ভাল হয়। কিন্তু সেদিন নৌকাতে কাউকে ঘুমাতে দেখা গেল না। দু’টি নৌকাই খালি পড়ে আছে এবং লগির খুটিতে বাঁধা।

আমি পছন্দ মত একটিতে উঠে বাঁধন খুলে লগি হাতে নৌকার এক প্রান্তে চরাটে বসে পড়লাম। উদ্দেশ্য যতদূর পর্যন্ত নৌকায় ভেসে বেড়ানো যায়। আমাদের বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ দু’দিকেই খোলা মাঠ আর এখন তা পানিতে সয়লাভ।

পানির ওপারে বহুদূরে গ্রামগুলো জমাট পাহাড়ের মত মনে হয়। মাঝেখানে সাদা পানির চাদোয়া। আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে একটা বড় বিল আছে। এখন বর্ষাকালে বিলের গভীরতা আনেক বেশী। ছোটবেলা থেকেই এ বিলে অনেক ভয়ের কাহিনী সকলেরই জানা। কাজেই বিলের দিকে না গিয়ে দক্ষিণ দিকে স্বল্প পানির মাঠের পানে নৌকা বাইতে লাগলাম।

অনেক দূর যাওয়ার পর নৌকা থামিয়ে দিলাম। মনে একটু ভয়ের শিহরণ জাগল। বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। বিপদে পড়লে এখন কাউকে ডেকেও পাওয়া যাবে না । তখন মনে হল পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কোন জন প্রাণীর বুঝি অস্তিত্ব নেই।

আশে পাশে কোথাও জনমানবের কোন সাড়া নেই। রাত জাগা পাখিদেরও কোন সাড়া শব্দ নেই। শুধু উন্মুক্ত মাঠের বিশাল জলরাশির উপর দিয়ে ভেসে আসা ছোট ছোট ঢেউগুলো আমার নৌকার গোলুইয়ে মৃদুমন্দ আঘাত করছে আর সে আঘাতে আমার ছোট ডিঙি নৌকাটি নেচে নেচে উঠছে। রাতের গভীরতা আর নৌকার দুলোনিতে সেসময় আমার মৃদু ঘুম পাচ্ছিল।

কিন্তু তেপান্তরের মাঝ মাঠে গহীন জলরাশির উপর নৌকাতে একলা ঘুমানোর সাহস আমার মোটেও ছিল না। এছাড়া নিঝুম নির্জনতাও মানুষের মনে ভয়েরও উদ্রেক করে।

অনেকক্ষণ হল আমার মধ্যে ভয় এসে দেহমনে ভর করেছে। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্বেও কেন জানি চুপচাপ বসে আছি। খোলা মাঠের শীতল হাওয়ায় শরীরও বুঝি উষ্ণতা হারিয়ে ফেলেছে । লগি বৈঠা চালানোর মত যথেষ্ট শক্তি গায়ে নেই তা বুঝতে পারছি।

ক্ষুধার জ্বালায় শরীরও অসার হয়ে পড়েছে। রাত জাগলে কার না ক্ষুধা পায়? গরীবের ঘরে জন্ম নেয়াতে তিন বেলা তিন মুঠো ভাত রুটি ভিন্ন আর কিছু পেটে পড়ে না। সব মিলে আমার অবস্থা সঙ্গীন। আমি যেন মুড়িয়ে যাচ্ছি।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার চোখে একটি দৃশ্য দেখা দিল। বেশ দূরে পানির উপর কী একটি কালো বস্তু দেখা যায়। খানিক আগেও সেটিকে সেখানে দেখতে পাওয়া যায় নি। কচুরিপানা না কী? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

না, কচুরিপানা হলে এত দূরে এত বড় দেখাবে না। তা হলে কী হতে পারে? আরো কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলাম। না সেটি ক্রমান্বয়ে বড় দেখাচ্ছে ক্যান?? শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। নিজেকে খুব ধিক্কার দিলাম।

বোকা কোথাকার,কী প্রয়োজন ছিল এতো রাতে নির্জনে একাকী পানির উপর ভেসে বেড়ানো। কথায় আছে না “দু:সাহসে দু:খ হয়’’। আজ কী আছে কপালে জানি না। যদি ওটা খারাপ কিছু হয় তবে আমাকে আচ্ছামত পানিতে চুবিয়ে মারবে।

সকালে কেউ টের পাবে না আ: রহিম কোথায় গেছে, কোথায় আছে? যা হবার তা আজ হবে। আগে জিনিসটা ভাল কের দেখে নেই আর একবার। ওরে মা, ও বাবারে বলে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল ।

দেখলাম সেটি আরো বড়, আরো কালো এবং আরো নিকটবর্তী হয়েছে আমার। শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে লগি চালালাম। কিন্তু না ওটি এখন আমার খুব কাছাকাছি। ওর সাথে আর পেরে উঠা সম্ভব নয়। ইচ্ছে করলে আর দুই/এক মিনিটের মধ্যে ও এসে আমাকে ধরে ফেলবে। কিন্তু না, ওরা আমাকে ধরল না কিছু বললও না। আমার কুড়ি পঁচিশ হাত দূর দিয়ে চলে গেল।

আসলে সেটি ছিল একটি জেলে নৌকা। বড়সড় একটি নৌকার মাঝখানে কালো রঙের তাদের বেড়জাল স্তুপ করা ছিল। আর সেই জালের উপরে আগে পিছে বেশ কয়েজন জেলে লুঙ্গি বা গামছা পরে মাল কোচা মেরে দাঁড়িয়ে ছিল।

আর কয়েকজন লগি-বৈঠা,দাড় টেনে তরতর বেগে ছুটে যাচ্ছিল । প্রথমে তাদের জালের স্তুপটাই শুধু চোখে পড়েছিল। মনে হয়েছিল কালো কোন বস্তু জলের উপর দিয়ে ভেসে আসছে। নৌকাটি আমার কাছাকাছি আসলে ক্রামন্বেয়ে সব কিছু দৃশ্যমান এবং পরিষ্কার হয়ে উঠল।

তারা যখন আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল তখন আর ভয়ডর কিছু থাকল না। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তারা এত রাতে কোথায় যায় কী করে? পরে দেখলাম জেলেরা তাদের নৌকাটি আমাদের বাড়ির সামনে বড় পুকুর পাড়ের জমিতে অপেক্ষাকৃত কম পানিতে গিয়ে জাল ফেলছে। ইচ্ছা থাকা সত্তেও তাদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখা আর হল না।

ঘুমে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসছে। পূর্ব আকাশে হালকা মেঘের উপর ভোরের আভাস রেখা ফুটে উঠছে। খুব দূরের কোন মসজিদ থেকে ফজরের নামাজের সুমধুর আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসছে। অবশেষে সেই আলো-অন্ধকারে রাত জাগা পাখির মত রক্ত রাঙা চোখে ঘরে ফিরে এলাম। সালটা হবে ১৯৮০।